বিনয় ও নম্রতা : মর্যাদা লাভের অন্যতম সোপান

Sun, 10 April, 2022 9:34 AM

শান্তিময় সুন্দর জীবনের জন্য বিনয় ও নম্রতা অবলম্বন করা অপরিহার্য। বিনয় হলো আল্লাহর জন্য অন্যান্য বান্দাদের তুলনায় নিজেকে ছোট জ্ঞান করা এবং অন্যদের বড় মনে করা। বিনয় মহান আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় এবং ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ কাম্য একটি গুণ। যার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর প্রকৃত বান্দায় পরিণত হয়। অন্যকে প্রাধান্য দেওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়। মানবিক গুণাবলি বিকশিত হয়। ফলে সংঘাতমুক্ত শান্তিময় সমাজ গড়ে উঠে। বিনয়ের বিপরীত হলো- অহংকার ও আত্মম্ভরিতা। মাটির তৈরি মানুষের জন্য যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বরং বড়ত্ব ও মহানত্ত্ব কেবল মহান আল্লাহর জন্যই শোভা পায়। বিনয়ের বিষয়ে আল্লাহ বলেন, ‘পরম করূণাময় আল্লাহর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে বিনয়ের সাথে চলে’। (সুরা ফুরকান, আয়াত: ৬৩)

নবী কারীম (সা.) বলেন, ‘যে কেউ আল্লাহর জন্য বিনয় অবলম্বন করে আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন’। (মুসলিম, হাদিস: ৬৭৫৭)

একজন বিনয়ী সাহাবী:

সাহাবীদের মধ্যে অন্যতম ফকিহ সাহাবি হলেন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)। বিনয় ও নম্রতার দিক থেকে তিনি ছিলেন সবার উপরে। নবী (সা.) এক রাতে জিনদেরকে দীনের দাওয়াত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। যাওয়ার আগে ঘোষণা করলেন, আজকে এমন একজন আমার সাথী হবে যার হৃদয়ে সামান্য পরিমাণও অহংকার থাকবে না। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) দাঁড়িয়ে গেলেন। নবী (সা.) তাকে সঙ্গে নিয়ে জিনদের উদ্দেশ্যে বের হলেন। গন্তব্যে পৌঁছে নবী (সা.) একটি বৃত্ত-রেখা টেনে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) কে তার মধ্যে থাকতে বললেন। অন্য দিকে নবী (সা.) জিনদের দীনের দাওয়াত প্রদান করলেন। [মুহাম্মদ ইদরিস কান্ধালভি, সিরাতুল মুস্তাফা, ২য় খণ্ড (দেওবন্দ: দারুল কিতাব, তা. বি.), পৃ. ১০০]

উল্লেখ্য যে, অভিশপ্ত ইবলিস জিনদেরই একজন ছিল। আল্লাহর অবিরাম ইবাদত-বন্দেগি তাকে ফেরেশতাদের নেতৃত্ব দানের মতো মর্যাদায় সমাসীন করেছিল। এক পর্যায়ে মহান আল্লাহ প্রথম মানব আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করে ফেরেশতাদের প্রতি তাকে সিজদা করার নির্দেশ প্রদান করলেন। সব ফেরেশতা বিনয়ের সাথে আল্লাহর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করলেও অহংকার ইবলিসকে পেয়ে বসে। সে যুক্তি প্রদর্শন করে আল্লাহকে বলে- ‘আমি তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ, তুমি আমাকে সৃষ্টি করেছ আগুন থেকে আর তাকে সৃষ্টি করেছ মাটি থেকে’। (সুরা আরাফ, আয়াত: ১৩)

এই অহংকার তার পতন ডেকে আনে। ফেরেশতাদের নেতৃত্বদানের জায়গা থেকে পরিণত হয় অভিশপ্ত শয়তানে। অহংকারী এই জাতির প্রতি দীনের দাওয়াত প্রদানে নিরহংকার এবং অতি বিনয়ী একজনকে সাথী হিসেবে নির্বাচন করা খুবই সঙ্গত বিষয়। নবী (সা.) সেটিই করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এর সর্বাধিক বিনয়ী হওয়ার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিও হয়েছে।  

সর্বাধিক বিনয়ীর হাতে সর্বাধিক অহংকারীর পতন:

মহান আল্লাহ নিরহংকার এবং বিনয়ী এই সাহাবীর মাধ্যমেই উম্মতের ফেরআউন খ্যাত অহংকারী আবু জাহলের পতন ঘটিয়েছেন। আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) বর্ণনা করেন- বদরের দিন আমি যুদ্ধের সারিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ দেখি আমার ডানে ও বাঁমে আনসারি দুজন কিশোর দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মাঝে যখন আমি কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছি; তখনই তাদের একজন আমাকে চুপি-চুপি জিজ্ঞেস করলো, হে চাচা! আপনি আবু জাহলকে চেনেন? আমি তাকে বললাম, ভাতিজা! আমি তাকে চিনি। তবে তাকে তোমার কী দরকার? সে উত্তর দিল, আমি শুনেছি- সে (আবু জাহল) নবী (সা.)কে অনেক কষ্ট দিয়েছে। আল্লাহর শপথ! আমি যদি তাকে দেখতে পাই, আমার ছায়া তাকে অতিক্রম করবে না, যতক্ষণ না আমি তাকে হত্যা করি কিংবা সে আমাকে হত্যা করে। তিনি বলেন, আমি তার কথায় অভিভূত হলাম ও স্বস্তি অনুভব করলাম। অন্যজনও আমাকে তেমনই বললো। পাশে দাঁড়ানো দুই কিশোরের কথায় আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) যখন বিস্মিত হচ্ছিলেন; তখনই যুদ্ধের ময়দানে আবু জাহলকে ছুটতে দেখলেন। তিনি কিশোর দু’জনকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন- তোমরা আমার কাছে যার পরিচয় জানতে চেয়েছো; ঐ যে সে যাচ্ছে। শোনা মাত্রই তারা তরবারি নিয়ে আবু জাহলের উপর ঝাপিয়ে পড়ে তাকে ধরাশায়ী করে দিল। (বুখারি, হাদিস: ২৯৭২) সে সময় শুধু তার শ্বাসঃপ্রশ্বাসটুকুই অবশিষ্ট ছিল।

আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, (যুদ্ধ শেষে) নবী (সা.) বলেন, এমন কে আছে যে, আবু জাহলের খবর নিয়ে আসবে? আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) নিহতদের মধ্যে অনুসন্ধান চালিয়ে আবু জাহলকে খুঁজে পেলেন। আফরার দুই ছেলের আঘাতে মৃতপ্রায় অবস্থায় পড়ে আছে। (বুখারি, হাদিস: ৩৭৪৫) এমতাবস্থায় আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) তার বুকের উপর উঠে বসেন। আবু জাহল চোখ খুলে দেখে-আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ তার বুকের উপর। এতে আবু জাহল অপমানবোধ করে বলে, ওহে ছাগলের রাখাল! তুমি অনেক বড় স্থানে চড়ে বসেছো। এত বড় সম্মানিত উচ্চাসনে এর আগে কেউ বসেনি। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, আল্লাহর প্রশংসা যিনি আমাকে এই সুযোগ দান করেছেন। আজকে কার দিন? আজকে কে বিজয়ী হয়েছে? আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল (সা.) বিজয়ী হয়েছেন। আবু জাহল বলে, আমাকে আমার তরবারি দিয়ে হত্যা করবে এবং আমার মাথা গলাসহ বড় করে কাটবে যেন আমাকে দর্শকরা বড়ই দেখে। আর মুহাম্মাদের কাছে বলবে- আজও আমার মনে তোমাদের প্রতি অতীতের চেয়ে বেশি শত্রুতা এবং ঘৃণা রয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) এর হাতেই আবু জাহল নিহত হয়। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) নবী (সা.) কে সবকিছু অবগত করলে নবী (সা.) বলেন- আবু জাহল আমার এবং আমার উম্মতের ফেরআউন; যার অনিষ্ট মুসা (আ.)-এর ফেরআউনের অনিষ্ট থেকে বেশি। মুসা (আ.) এর ফেরআউন মৃত্যুর সময় নমনীয় হয়ে ঈমানের কালিমা পড়েছিল। (জীবনের একেবারে শেষ সময় হওয়ার কারণে যদিও তা গ্রহণযোগ্য হয়নি) কিন্তু এই উম্মতের ফেরআউন মৃত্যুর সময়ও কুফর ও অহংকার ছাড়েনি। (সিরাতুল মুস্তাফা, ২য় খণ্ড, পৃ. ১০১-২)

আল্লাহ তায়ালা এভাবেই বিনয়ীকে মর্যাদা দান করেন এবং অহংকারীর পতন ঘটান। সবাই যথার্থভাবে বিনয় ও নম্রতার গুণটি অর্জন করতে পারলে পৃথিবী শান্তির আবাসনে রূপান্তরিত হবে এবং পরকালীন সফলতার পথ উন্মুক্ত হবে ইনশাআল্লাহ।

ড. আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা

সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *