শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা জাতির জন্য আলোর পথের দিশারী। আদর্শ জাতির জন্য শিক্ষার বিকল্প নেই। কিন্তু মানব রচিত পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা মানব জীবনের সার্বিক কল্যাণ ও মুক্তির জন্য যথেষ্ট নয়। একমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত ইলমে অহীভিত্তিক দ্বীনি শিক্ষাব্যবস্থা এবং তার অনুকরণই মানুষের সার্বিক কল্যাণ ও মুক্তির নিশ্চয়তা দিতে পারে।
পাশ্চাত্য শিক্ষা ও বিজাতীয় সংস্কৃতির বিষফল থেকে মুসলিম জাতিকে রক্ষা ও দ্বীনি শিক্ষার পুনর্জাগরণের প্রত্যয় নিয়ে ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বখ্যাত ইসলামী বিদ্যাপীঠ দারুল উলূম দেওবন্দ। বর্তমান উপমহাদেশে প্রচলিত কওমী মাদরাসাসমূহ দারুল উলূম দেওবন্দেরই আদর্শের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সেই দারুল উলূম দেওবন্দের সুযোগ্য সন্তান মুফতী আব্দুল জব্বার কাসেমী দারুল উলূম দেওবন্দের পাঠ্যক্রমানুসারে ১৯৯৪ সালের ২০ মে প্রতিষ্ঠা করেন জামি‘আ রহমানিয়া রাজশাহী।
ভৌগলিক অবস্থান ও বেদনাময় ইতিহাস:
রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের অন্তর্গত চন্দ্রিমা (সাবেক বোয়ালিয়া) থানার ১৯ নং ওয়ার্ডের শিরোইল কলোনি এলাকায় সাধারণ জনগণের সহযোগিতায় রেলওয়ের একটি নোংরা নর্দমা লিজ নিয়ে জামি‘আ রহমানিয়ার শুভযাত্রা শুরু হয়। প্রথম দিকে টিনের চাল ও বাঁশের বেড়া দিয়ে সেখানে সকাল-বিকাল কুরআনের তালিম হতো। এলাকার ছেলে-মেয়েরা সকাল-বিকাল এসে পড়ে চলে যেত। আবাসিকও থাকত কিছু ছাত্র। ছাত্ররা খুব কষ্ট করে কালাতিপাত করত। আলহাজ্ব আব্দুস সালাম সাহেব এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সাথে মাদরাসার বিষয়ে আলাপ আলোচনা করেন এবং তাদের আন্তরিকতায় নিয়মতান্ত্রিকভাবে মাদরাসা পরিচালনার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। সেই সূচনালগ্ন থেকেই মাদরাসার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন আলহাজ্ব আব্দুস সালাম সাহেব। তাঁর গত হওয়া বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল (আল্লাহ তাকে জান্নাতে উঁচু মাকাম দান করুন)। বহু বাধা-বিপত্তি ও চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে মাদরাসা পৌঁছতে থাকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যপানে। প্রথমে মক্তব, এরপর হিফজ বিভাগ চালু করা হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে কিতাব বিভাগ খোলা হয়। হাটি হাটি পা পা করে মাদরাসা তার আপন গতিতে সুচারুরূপে পরিচালিত হতে থাকে। মাদরাসা ২০০৩ সালে ফযিলত (২য় বর্ষ) (মিশকাত) জামাত পর্যন্ত উন্নীত হয়। নোংরা নর্দমা ক্রমান্বয়ে ইলমে দ্বীনের সুশোভিত ও সুবাসিত বাগানে পরিণত হয়। কিন্তু ২০০৭ সালের সেই বাগান উচ্ছেদ অভিযানে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়, মিশে যায় মাটির সাথে।
২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা লিজকৃত জায়গার সকল স্থাপনা ভেঙ্গে দেওয়ার নির্দেশ দেন। এতে বাদ যায়নি জামি‘আ রহমানিয়া মাদরাসা-মসজিদও। ২০০৭ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। সকাল বেলা মাদরাসাতে কুরআন তেলাওয়াত চলছে, হঠাৎ করে মাদরাসার দক্ষিণ পার্শ্বের কয়েকটি পায়খানা ভেঙ্গে দিয়ে চলে যায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উচ্ছেদবাহিনী। মনে হলো হয়ত বা আর মাদরাসা ভাঙ্গবে না। শুকরিয়াতান দুই রাকায়াত নামাজ আদায় করা হলো। কিন্তু হায়! কিছুক্ষণ পর কোনো এক অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিতে তারা আবার বুলডোজার নিয়ে এল। হ্যান্ডমাইক হাতে ঘোষণা দিল মাত্র ৫ মিনিটের ভেতরে যেন সব বের করে নেওয়া হয়। মাদরাসার শিক্ষক, ছাত্ররা যেন দিকভ্রান্ত হয়ে পাগলের মতো ছুটাছুটি করতে লাগল। খুব দ্রুত যথাসম্ভব কিতাবপত্র, মাদরাসার লাইট, ফ্যানসহ যাবতীয় আসবাবপত্র বের করার ব্যবস্থা করা হল। মনে হচ্ছিল যেন কিয়ামতের বিভীষিকা নেমে এসেছে। আফসোস, উচ্ছেদবাহিনী মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে আসবাবপত্রগুলো বের করার সুযোগ দিল না। জোহরের নামাজের পর সবেমাত্র ছাত্রদের দুপুরের খাবার দেওয়া হচ্ছে, এ সময় বুলডোজার দিয়ে মাদরাসার ঘর-দরোজা ভাঙ্গা শুরু হলো। ছাত্রদের আর খাওয়া হলো না। ছাত্র-শিক্ষকদের অসহায়ের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। চোখের সামনে তিল তিল করে কষ্টে গড়া মাদরাসা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, তা মেনে নিতে পারছিলেন না তারা। বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন তারা। ছোট ছোট নিষ্পাপ শিশুদের গগনবিদারী কান্নায় পরিবেশ বেশ ভারী হয়ে ওঠে। মাদরাসার মুহতামিম মুফতী আব্দুল জব্বার কাসেমী সাহেব তার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, মাদরাসার একেকটি ইটকে যখন বুলডোজার দিয়ে আঘাত করা হচ্ছিল, তখন মনে হচ্ছিল ইটে নয়, যেন আমার অন্তরের গহীনে বুলডোজার দিয়ে আঘাত করা হচ্ছে।
এক সপ্তাহের জন্য মাদরাসা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। মাদরাসার এ দুঃসময়ে কাছে এসে সহযোগিতার হাত বাড়ান বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সমাজসেবক জনাব আব্দুল আওয়াল সাহেব। তিনি একান্তই ব্যক্তিগত উদ্যোগে শিরোইল কলোনী (কানার মোড়) বাইতুল মামুর জামে মসজিদের দ্বিতীয় তলায় ছাত্রদের আবাসনের ব্যবস্থা করেন। এক সপ্তাহ পর এখানেই নিয়মতান্ত্রিকভাবে দরস শুরু হয়। তবে কিছু ছাত্র তৎকালীন সেক্রেটারি আব্দুল্লা-হিল-কাফি চৌধুরীর বাসায় এবং কিছু ছাত্র সভাপতি সাহেবের বাসায় অবস্থান গ্রহণ করে।
মাদরাসা ছোটবনগ্রামে স্থানান্তর:
বিভিন্ন জায়গায় জমির সন্ধান চলতে থাকে। একপর্যায়ে ছোটবনগ্রামে আজকের এ জমির সন্ধান পাওয়া যায়। মূল্য ৪২ লক্ষ টাকা। মুহতামিম সাহেব তার বন্ধু মাওলানা আব্দুল হামিদ কাসেমী সাহেবের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে জমি ক্রয় করেন। কান্না আর দোয়ার বরকতে আল্লাহর অপার মেহেরবানীতে মাদরাসা শিরোইল কলোনি থেকে ২২ সেপ্টেম্বর, ২০০৭ সালে ছোটবনগ্রামে স্থানান্তরিত হয়। ৪২ লক্ষ টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে এখানে নতুনভাবে শিক্ষাকার্যক্রম শুরু হয়। নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে ঋণ পরিশোধের জন্য টাকার ব্যবস্থা না হওয়ায় মুহতামিম সাহেব তার নিজের জমি-বাড়ি-অফিস বিক্রয় করে ঋণ পরিশোধ করে আত্মত্যাগের এক বিরল দৃষ্টান্ত পেশ করেন। বর্তমানে চন্দ্রিমা (সাবেক বোয়ালিয়া) থানার ১৯ নং ওয়ার্ডের এ ছোটবনগ্রামেই প্রায় ৩০০ ছাত্র, ২৫ জন শিক্ষকসহ ফযিলত (২য় বর্ষ) (মিশকাত) জামাত পর্যন্ত মাদরাসা সুচারুরূপে পরিচালিত হচ্ছে। মাদরাসাটির অবস্থান হচ্ছে শালবাগান থেকে পূর্ব দিকে এসে ক্লাবমোড়ের পাশে। ভদ্রা মোড় দিয়ে পদ্মা-চন্দ্রিমা আবাসিক এলাকার পশ্চিম দিকে মাদরাসার অবস্থান।