Mon, 11 April, 2022 5:23 PM
সমগ্র দুনিয়াবাসীর হেদায়েতের জন্য যে দ্বীনে হক নিয়ে বিশ্বনবী (সঃ) পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন, তার প্রথম ভিত্তি হলো ঈমান ও তাওহীদ। ঈমান ও তাওহীদপন্থী সমস্ত মুসলমানের যাপিত জীবনে ইসলামের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান রয়েছে । তা হলো –
১। হুকুকুল্লাহ তথা বান্দার উপর আল্লাহর হক ও অধিকারসমূহ ।
২। হুকুকুল ইবাদ তথা একজন বান্দার উপরে অন্য বান্দার ও প্রাণীর হক ও অধিকার সমূহ ।
স্মর্তব্য যে, হুকুকুল ইবাদ খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। হুকুকুল ইবাদ পালনের মধ্যে ইসলামের সৌন্দর্যতা ফুটে ওঠে। পরস্পরের মধ্যে হৃদ্যতা ও ভালোবাসা গড়ে ওঠে। কেউ কারো দ্বারা কষ্ট পায় না, মানবতার পূর্ণ বিকাশ ঘটে। পরিবার, সমাজ, দেশ ও বিশ্ব শান্তিপূর্ণ হয়ে ওঠে ।
অপরদিকে হুকুকুল ইবাদ আদায়ে যত্নবান না হলে একজনের দ্বারা অপরজন জুলুমের শিকার হবে। এক্ষেত্রে ক্ষমার একমাত্র উপায় হলো, যার অধিকার নষ্ট করা হয়েছে, তার কাছ থেকে মাফ নেয়া। অন্যথায় কেয়ামতের দিন বড় ধরনের শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে ।
তিরমিযির ২৮১৮ নম্বর হাদীসে দেখতে পাই, রাসূল সাঃ বলেন,
“আমার উম্মতের মধ্যে আসল নিঃস্ব তো সেই ব্যক্তি, যে কিয়ামতের দিন অনেক নামাজ, রোজা ও যাকাতের নেকি নিয়ে হাজির হবে । কিন্তু এর সঙ্গে সে এমন অবস্থায় আসবে যে, সে কাউকে গালি দিয়েছে, কারও প্রতি মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছে, কারও মাল অবৈধ ভাবে ভক্ষণ করেছে, কারও রক্তপাত করেছে এবং কাউকে মেরেছে। (অর্থাৎ সে বান্দার হকসমূহ নষ্ট করেছে।)
অতঃপর অমুক অমুক অত্যাচারিত ব্যক্তিকে তার নেকিগুলো দেওয়া হবে। পরিশেষে যদি তার নেকি অন্যদের হক দাবি পূরণ করার আগেই শেষ হয়ে যায়, তাহলে তাদের পাপসমূহ তার উপর চাপানো হবে। অতঃপর অন্যদের পাপের বোঝার কারণে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে” ।
হুকুকুল ইবাদ একটি ব্যাপক ও বিস্তৃত বিষয়, যে সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। ওলামায়ে কেরাম এর উপর বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করেছেন। আমাদের জন্য এগুলো শিক্ষা করা ও চর্চা করা জরুরি।
হুকুকুল ইবাদ সম্পর্কিত একটি ব্যাপক অর্থবহ আয়াত:
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, “এবং আল্লাহর ইবাদত করো ও তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক সাব্যস্ত করো না । আর পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো। আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতিম, মিসকিন, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশীর সঙ্গে বসা (বা দাঁড়ানো ব্যক্তি), পথচারী এবং নিজেদের দাস-দাসীদের প্রতিও সদ্ব্যবহার করো, নিশ্চয় আল্লাহ কোন দর্পিত অহংকারীকে পছন্দ করেন না। (সূরা নিসা; আয়াত-৩৬)
আল্লাহ তায়ালা উল্লেখিত আয়াতে সমগ্র নর-নারীদের তাদের নিজেদের প্রতি কিছু গুরত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছেন। আয়াতে বর্ণিত এই দশটি মহান দায়িত্ব মানব জীবনের মুক্তি ও উন্নতির সোপান।
নিজের মুক্তি ও কল্যাণের জন্য একমাত্র আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করা ও যে কোনো কিছুকে তাঁর সাথে শরীক না করা।
পিতা-মাতার সাথে ভালো ব্যবহার করা। পিতা-মাতার সম্মান অনেক বেশী। সূরা বনী ইসরাইলের ২৩ নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা স্বীয় হকের পরেই পিতা-মাতার হকের কথা বলেছেন। উল্লেখ্য যে, পিতা-মাতার কর্তব্য হলো সন্তানদের কুরআন ও সুন্নাহর প্রয়োজনীয়তা শিক্ষা দেওয়া। যাতে তারা পিতা-মাতার হক সম্পর্কে অবগত হতে পারে।
নিকটতম আত্মীয়দের সাথে সদাচরণ করা, আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করা। প্রয়োজনের সময় তাদের পাশে দাঁড়ানো। তাদের মধ্য থেকে দরিদ্রদের দান খয়রাত করা। এতে দ্বিগুণ সওয়াব পাওয়া যাবে । আর তাদের কেউ কোন প্রকার কষ্ট দিলে ধৈর্য ধারণ করা ও মাফ করে দেওয়া উচিত।
এতীমের সাথে উত্তম ব্যবহার করা। হযরত সাহল বিন সা’দ রাঃ বলেন, রাসূল সাঃ বলেছেন, জান্নাতের মধ্যে আমি ও এতীমের লালন-পালনকারী এরূপ থাকবো। একথা বলে রাসূল (সাঃ) হাতের শাহাদাত আঙুল ও মধ্যমা আঙুল সামান্য ফাঁকা রেখে ইশারা করলেন (বুখারী হাদীস-৫৩০৪) । এতীমের সাথে ভালো ব্যবহার সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসে অনেক কথা এসেছে।
কুরআন ও হাদীসে বিভিন্ন ভাবে মিসকিনদের সাথে নরম ও কোমল আচরণ করতে আদেশ করা হয়েছে । তাদের ধমক দেয়া ও কঠোরতা করা থেকে বারণ করা হয়েছে । আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, “সুতরাং আপনি এতিমের প্রতি কঠোর হবেন না। সওয়ালকারীকে ধমক দিবেন না।” (সূরা আদ-দ্বোহা, আয়াত- ৯-১০)
প্রতিবেশীর সঙ্গে ভালো আচরণ করা, চাই সে প্রতিবেশী কাছের বা দূরের হোক, আত্মীয় বা অনাত্মীয় হোক, মুসলিম বা অমুসলিম হোক। মোটকথা সকল প্রকার প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচরণ করা । তাদের হকগুলো যথাযথভাবে পালন করা।
সঙ্গী সহচরের সাথে উত্তম আচরণ করা, সফরের সঙ্গী, উস্তাদ, ছাত্র, সহপাঠী ও স্বামী-স্ত্রী এর অন্তর্ভুক্ত। এমনকি, যে সামান্য সময়ের জন্য মসজিদ, ওয়াজ মাহফিল বা গাড়িতে সঙ্গী হয়েছে, সেও এর অন্তর্ভুক্ত। সাথে করে মুসাফিরের সাথেও ভালো ব্যবহার করা । উপসংহার: হুকুকুল ইবাদ সম্পর্কে সামান্য আলোচনা করা হলো। কুরআন ও হাদীসে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। অনেক উলামায়ে কেরাম স্বতন্ত্র পুস্তিকাও রচনা করেছেন। বিশেষত হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. এর এ বিষয়ে বেশ কয়েকটি বই রয়েছে। তন্মধ্যে ১। হুকুকুল ইসলাম ২। হুকুকুল ওয়ালিদাইন ৩। আদাবুল মুয়াশারাত এগুলো পড়ি ও শুনি এবং সে অনুযায়ী আমল করি। আল্লাহ তায়ালা সকলকে তাওফীক দান করুন। আমীন।
মুফতি মুজাহিদুল ইসলাম ফয়েজী
শিক্ষক, জামি‘আ রহমানিয়া রাজশাহী
Leave a Reply