Sun, 10 April, 2022 3:04 PM
আল্লাহ রব্বুল আলামীন পথভোলা মানুষের হেদায়েতের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী ও রসূল প্রেরণ করেছেন। তাঁরা আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত ইলমে ওহীর মাধ্যমে মানুষের মাঝে হেদায়েতের আলো ছড়িয়ে দিতে নির্মোহ মেহনত করে গেছেন। এ ধারার সর্বশেষ নবী ও রসূল আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তিনি খাতামুন নাবিয়্যিন। এ মাটির পৃথিবীতে তাঁর পরে আর কোনো নবীর আগমন ঘটবে না। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন-
أَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّيْنَ لَا نَبِيَّ بَعْدِيْ. رواه أبو داود
‘আমি খাতামুন নাবিয়্যিন, আমি শেষ নবী। আমার পরে আর কোনো নবীর আগমন ঘটবে না।’-আবু দাউদ
এ পৃথিবী টিকে থাকবে আরও বহুদিন। থাকবে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষও। কিন্তু সেই মানুষ যখন সিরাতে মুসতাকীমের আলোকিত পথ হারাবে, তখন তাদের পথ দেখাবে কে? নবী-রসূল আসবেন না, তাহলে তাদের হেদায়েতের মহান বাণী শোনাবে কে? যেহেতু আল্লাহ রব্বুল আলামীন নবী-রসূলের আগমনের ধারা শেষ করে দিয়েছেন, তাই দুনিয়ার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এর বিকল্প ব্যবস্থাও আল্লাহ তায়ালা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। সেই বিকল্প ব্যবস্থায় পথভোলা মানুষের কাছে পথের দিশা বাতলে দিতে মহাসত্যের আলো নিয়ে হাজির হবেন উলামায়ে কেরাম নবীর ওয়ারিস হয়ে, নায়েবে নবী হয়ে।
নবী-রসূলের আগমনের ধারা বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে ইলমে ওহী আগমনের ধারাও বন্ধ হয়ে গেছে। আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর পূর্ণাঙ্গ ইলমে ওহী নাজিল করেছেন। উলামায়ে কেরামকে সেই হিরন্ময় ইলমে ওহীর ওয়ারিস বা উত্তরাধিকারী সাব্যস্ত করা হয়েছে। আগামী পৃথিবীর জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে এ এক অপূর্ব ফয়সালা।
এ প্রসঙ্গে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অমোঘ বাণী উল্লেখযোগ্য-
عَنْ كَثِيْرِ بْنِ قَيْسٍ رَضِيَ اللهُ تَعَالٰي عَنْهُ، قَالَ: كُنْتُ جَالِسًا مَعَ أَبِي الدَّرْدَاء، فِيْ مَسْجِدِ دِمَشْقَ فَجَاءَهُ رَجُلٌ، فَقَالَ: يَا أَبَا الدَّرْدَاءِ: إِنِّيْ جِئْتُكَ مِنْ مَدِيْنَةِ الرَّسُوْلِ صَلَّي اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ لِحَدِيْثٍ، بَلَغَنِيْ أَنَّكَ تُحَدِّثه عَنْ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، مَا جِئْتُ لِحَاجَةٍ، قَالَ فَإِنِّيْ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ: مَنْ سَلَكَ طَرِيْقًا يَّطْلُبُ فِيْهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللهُ بِهِ طَرِيْقًا مِّنْ طُرُقِ الْجَنَّةِ، وَإِنَّ الْمَلَائِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا رِضًا لِطَالِبِ الْعِلْمِ، وَإِنَّ الْعَالِمَ لَيَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ وَالْحِيْتَانُ فِيْ جَوْفِ الْمَاءِ، وَإِنَّ فَضْلَ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ عَلَى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ، وَإِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِ، وَإِنَّ الْأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوْا دِيْنَارًا وَلَا دِرْهَمًا وَإِنَّمَا وَرَّثُوا الْعِلْمَ، فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَّافِرٍ. رواه أبو داود، باب الحث على طلب العلم
হযরত কাসীর ইবনে কায়স রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি দামেশকের মসজিদে আবুদ দারদার সাথে বসেছিলাম। এ সময় এক ব্যক্তি এসে বলে, হে আবুদ দারদা, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মদীনা থেকে একটি হাদীসের জন্য আপনার কাছে এসেছি। আমি জেনেছি, আপনি উক্ত হাদীস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণনা করে থাকেন। এছাড়া আর কোনো কারণে আমি এখানে আসিনি। তখন আবুদ দারদা রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি ইলম অর্জনের জন্য কোনো রাস্তা অতিক্রম করে, আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতের রাস্তাসমূহের মধ্যে একটি রাস্তা অতিক্রম করান। আর ফেরেশতারা তালেবে ইলমের জন্য তাদের ডানা বিছিয়ে দেন এবং আলেমের জন্য আসমান ও জমীনের সব কিছুই মাগফিরাত কামনা করে, এমনকি পানিতে বসবাসকারী মাছও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর একজন আবেদের ওপর একজন আলেমের শ্রেষ্ঠত্ব এমন, যেমন পূর্ণিমার রাতে চাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব সকল তারকারাজির ওপর। আর আলেমগণ হলেন, নবীদের ওয়ারিস এবং নবীগণ দীনার (স্বর্ণমুদ্রা) ও দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) মীরাস হিসেবে রেখে যান না, বরং তাঁরা রেখে যান ইলমে ওহী। কাজেই যে ব্যক্তি ওই ইলমে ওহী অর্জন করল, সে বিশাল সম্পদের মালিক হলো।’ (আবু দাউদ)
এ হাদীস দ্বারা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, উলামায়ে কেরামকে নবীর ওয়ারিস বানানো হয়েছে। উলামায়ে কেরাম সাধারণ কোনো পার্থিব সম্পদের ওয়ারিস হন না, তারা ওয়ারিস হন মহামূল্যবান ইলমে ওহীর।
ইলমে ওহীর ওয়ারিস হওয়ার কারণে উলামায়ে কেরামের মাথার ওপর যেমন বিশাল দায়িত্ব ও কর্তব্য সদা বিদ্যমান, অনুরূপ উলামায়ে কেরামকে সম্মান করার বিধানও সদা বিদ্যমান।
ইলমে ওহীর ওয়ারিস হওয়ার কারণে উলামায়ে কেরামের ওপর যে মহান দায়িত্ব ও কর্তব্য অর্পিত হয়েছে তাকে ‘নবীওয়ালা কাজ’ বলা হয়। মহান রব্বুল আলামীন ‘নবীওয়ালা কাজ’-এর পরিচয় একেবারে স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি বলেন-
رَبَّنَا وَابْعَثْ فِیْھِمْ رَسُوْلًا مِّنْھُمْ یَتْلُوْا عَلَیْھِمْ اٰیٰتِكَ وَیُعَلِّمُھُمُ الْكِتٰبَ وَالْحِكْمَةَ وَیُزَكِّیْھِمْ
‘(ইবরাহীম আ. আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন) হে আমাদের প্রতিপালক, তাদের মাঝে এমন রসূল প্রেরণ করুন, যিনি তাদের কাছে আপনার আয়াত তেলাওয়াত করবেন, তাদের কুরআন ও তার মর্ম (হাদীস) শেখাবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন। (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১২৯)
এখানে ‘নবীওয়ালা কাজ’ হিসেবে চারটি দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা বলা হয়েছে।
১. যিনি কুরআন শরীফের সহীহ তেলাওয়াত শোনাবেন। সুতরাং নায়েবে নবী বা নবীর ওয়ারিস হতে হলে আগে নিজের কুরআন তেলাওয়াত সহীহ হতে হবে। যার নিজের কুরআন তেলাওয়াত সহীহ নয়, তিনি অন্যকে কীভাবে সহীহ কুরআন তেলাওয়াত শোনাবেন?
২. যিনি কুরআন শেখাবেন। অর্থাৎ উম্মতকে কুরআন শিক্ষা দেওয়া- এটাও ‘নবীওয়ালা কাজ’।
সুতরাং যারা নিজেদের কুরআন তেলাওয়াত সহীহ করে উম্মতের কুরআন তেলাওয়াত সহীহ করানোর জন্য মক্তব, হিফজ খানা ও বয়স্কদের কুরআন শেখানোর কাজে নিয়োজিত আছেন, তারা সকলেই ‘নবীওয়ালা কাজ’ করছেন।
৩. যিনি কুরআনের বিধান মানুষকে শেখাবেন। অর্থাৎ যিনি উম্মতকে কুরআনের বিধান মোতাবেক জীবন-যাপন পদ্ধতি শেখাবেন। মাসয়ালা-মাসায়েল শেখাবেন। সুন্নত শেখাবেন।
৪. মানুষের অপবিত্র আত্মাকে পবিত্র করবেন। মানুষের নফস, আত্মা বা মন নানাভাবে অপবিত্র হয়ে যায়। ফলে সে প্রবৃত্তির অনুগত দাস হয় এবং দুনিয়াপ্রীতি তাকে আল্লাহ থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়। তার আত্মার এ নোংরা ময়লা দূর করে তাকে পবিত্র করা ‘নবীওয়ালা কাজ’।
সুতরাং একজন আলেম যখন নায়েবে নবী বা নবীর ওয়ারিস হবেন, তখন তাকে এ মহান চারটি দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করতে হবে। আর সদা-সর্বদা ইলমে ওহীর জীবন-যাপন করতে হবে। ‘কম্প্রোমাইজ’ বা ‘হেকমত’-এর নামে ইলমে ওহীর আদর্শিক পরিধি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ উলামায়ে কেরামের নেই। কেননা তারা সদা-সর্বদার জন্যই নবীর ওয়ারিস। একজন আলেম যখন রাজনীতির মাঠে-মঞ্চে থাকবেন, তখনও যেমন তিনি নবীর ওয়ারিস, অনুরূপ তিনি যখন মাদরাসার মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করবেন, তখনও তিনি নবীর ওয়ারিস।
আল্লাহ তায়ালা নবীর সম্মানে পবিত্র কুরআনে বলেন-
یٰٓاَیُّھَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تُقَدِّمُوْا بَیْنَ یَدَىِ اللّٰهِ وَرَسُوْلِھٖ وَاتَّقُوا اللّٰهَ اِنَّ اللّٰهَ سَمِیْعٌ عَلِیْمٌ (1) یٰٓاَیُّھَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَرْفَعُوْٓا اَصْوَاتَكُمْ فَوْقَ صَوْتِ النَّبِیِّ وَلَا تَجْهَرُوْا لَھٗ بِالْقَوْلِ كَجَهْرِ بَعْضِكُمْ لِبَعْضٍ اَنْ تَحْبَطَ اَعْمَالُكُمْ وَاَنْتُمْ لَا تَشْعُرُوْنَ (2)
‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহ ও রসূলের সামনে অগ্রণী হয়ো না, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও জানেন। হে ঈমানদারগণ, তোমরা নবীর কণ্ঠস্বরের ওপর তোমাদের কণ্ঠস্বর উঁচু করো না এবং তোমরা একে অপরের সাথে যেরূপ উঁচুস্বরে কথা বলো, তাঁর সাথে সেরূপ উঁচুস্বরে কথা বলো না। এতে তোমাদের কর্ম নিষ্ফল হয়ে যাবে এবং তোমরা টেরও পাবে না।’ (সূরা আল হুজুরাত, আয়াত ১-২)
এ দুটি আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে মূলত দুটি আদবের কথা বলা হয়েছে। ১. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগে চলা যাবে না। ২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে উচ্চস্বরে কথা বলা যাবে না।
মুফাসসিরীনে কেরাম তাফসীরের কিতাবে লিখেছেন, উলামা মাশায়েখদের ক্ষেত্রেও এ বিধান কার্যকর। কেননা তারা নবীর ওয়ারিস-উত্তরাধিকারী। এ বিষয়টি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত। একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত আবুদ দারদা রা.কে হজরত আবু বকর রা.-এর আগে আগে চলতে দেখে সতর্ক করলেন এবং বললেন, তুমি এমন ব্যক্তির আগে চলছ, যিনি ইহকাল ও পরকালে তোমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। ইমাম কুরতুবী রহ. বলেন, নবীর উত্তরাধিকারী হওয়ার কারণে নবীর আগে হাঁটা সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞার আওতায় যেমন আলেমগণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন, তেমনিভাবে আওয়াজ উঁচু করারও বিধান অনুরূপ। আলেমগণের মজলিসে এত উঁচুস্বরে কথা বলবে না, যাতে তাদের আওয়াজ চাপা পড়ে যায়।
উপর্যুক্ত দুটি আদবের দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখতে পাই, আমাদের সমাজে নবীর ওয়ারিস উলামায়ে কেরামের প্রতি যথেষ্ট অসম্মান প্রদর্শন করা হয়। বহু মসজিদ-মাদরাসার সভাপতি-সেক্রেটারি, কমিটির অন্যান্য সদস্য ও দাতাগণ ইমাম-খতীব, বা মাদরাসার শিক্ষকদের সাথে খুবই খারাপ ব্যবহার করেন। উচ্চস্বরে ধমক দিয়ে কথা বলেন। অনেক মুসল্লীও ইমাম-খতীবের সাথে খুবই খারাপ আচরণ করেন। গলা উঁচিয়ে কথা বলেন। তারা মোটেও জানেন না, তারা কত বড় অন্যায় করেন। তারা মনে করেন, তারা তাদের বেতনভুক্ত ‘চাকর’-এর সাথে কথা বলেন, কিন্তু তারা জানেন না, তারা একজন নায়েবে নবী বা নবীর ওয়ারিসের সাথে চরম বেআদবীমূলক আচরণ করেন। যা স্পষ্টত কুরআনের নির্দেশ অবমাননার শামিল।
উলামায়ে কেরাম সবসময়ের জন্য নবীর ওয়ারিস। এক মুহূর্তের জন্য তাদের মহামূল্যবান ইলমে ওহীর উত্তরাধিকারী দায়িত্ব থেকে দূরে থাকার সুযোগ নেই। একই কারণে সামান্য সময়ের জন্যও তাদের অসম্মান করারও অবকাশ কারো নেই।
ড. মাওলানা ইমতিয়াজ আহমদ
ahmadimtiajdr@gmail.com
Leave a Reply