Mon, 4 April, 2022 4:45 PM
মানবজীবনে ইত্তেবায়ে সুন্নতের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা সুন্নতী পদ্ধতি ব্যতীত কোনো আমল আল্লাহর দরবারে প্রিয় হয় না এবং কবুল হয় না। রাসূলের শাফাআ’ত লাভ করতে চাইলে তার সুন্নত অনুসরণ ও অনুকরণ করাও মুসলিমদের জন্য একান্ত অপরিহার্য। অন্যথায় শাফাআ’ত লাভ না হওয়ার দরুণ জাহান্নাম অনিবার্য।
সুন্নতের শাব্দিক অর্থ:
ছবি, প্রতিচ্ছবি, প্রকৃতি, জীবনপদ্ধতি, কর্মধারা, রীতি, আদর্শ ইত্যাদি। ফকীহগণের পরিভাষায় নবী কারীম সা. আল্লাহ্র রাসূল হিসেবে যা কিছু বলেছেন, যা কিছু করেছেন এবং যা কিছু বলার বা করার অনুমতি দিয়েছেন অথবা সমর্থন জানিয়েছেন তাকে হাদীস বলা হয়।
একজন মুমিনের সুন্নতে নববীর অনুসরণ করা একান্ত কর্তব্য। পবিত্র কুরআনে কারীমের বিভিন্ন স্থানে স্বয়ং রব্বে আরশ কর্তৃক এর গুরুত্ব পাওয়া যায়। হাদীসেও এর গুরুত্ব সম্বন্ধে বিভিন্ন বর্ণনা এসেছে। রাসূল (সা.)-এর জীবনী মুমিনদের জন্য উৎকৃষ্ট এবং উত্তম আদর্শ। মুমিনকে আল্লাহ তাআলা একটি ব্যবস্থাই দিয়েছেন, যাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছে আল্লাহর নিকট কোনো কিছু আশা করার পূর্বশর্ত। আর তা হল রাসূলুল্লাহ সা. প্রদত্ত ব্যবস্থা ও তাঁর পবিত্র জীবনাদর্শ। নবীজি (সা.) এর ভালোবাসাতেই রয়েছে মুমিনের ঈমান এবং সুন্নাতের অনুসরণই হচ্ছে ভালোবাসার বড় প্রমাণ। এই বিষয়ে আল্লাহ পাক এরশাদ করেন,
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِیْ رَسُوْلِ اللّٰهِ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَنْ كَانَ یَرْجُوا اللّٰهَ وَالْیَوْمَ الْاٰخِرَ وَذَكَرَ اللّٰهَ كَثِیْرًا
অর্থ: যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রসূলুল্লাহ সা.-এর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে। (সূরা আহযাব; আয়াত-২১)
অন্য জায়গায় আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন,
قُلْ اِنْ كُنْتُمْ تُحِبُّوْنَ اللّٰهَ فَاتَّبِعُوْنِیْ یُحْبِبْكُمُ اللّٰهُ وَیَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوْبَكُمْ
অর্থ: বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসো, তাহলে আমাকে অনুসরণ করো, যাতে আল্লাহও তোমাদের ভালবাসেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। (সূরা আল-ইমরান-৩১)
সুন্নতের অনুসরণ এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, আল্লাহ তায়ালা আদেশসূচক বাক্যের মাধ্যমে রাসূলে কারীম সা.-কে অনুসরণ করতে বলেছেন। এর দ্বারা সুন্নতের ইত্তেবা বা অনুসরণ করার মূল্য বোঝা যায়।
এছাড়াও রাসূলের নির্দেশ মান্য করার নির্দেশও স্বয়ং আল্লাহর পক্ষ হতে বান্দাদের জন্য অবতীর্ণ হয়েছে। সূরা নিসার ৫৯ নং আয়াতে আল্লাহ নিজের এবং রাসূলের নির্দেশ মান্য করতে বলেছেন। কেননা ব্যক্তিজীবনে সফলতা কেবলমাত্র রাসূলের সুন্নতের ইত্তেবা করার দ্বারাই সম্ভব।
এমনিভাবে কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় রাসূলের সুন্নতের অনুসরণের গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে। জীবনের প্রতিটি ধাপে, প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি সমস্যার সমাধান রয়েছে রাসূলের পবিত্র জিন্দেগীতে।
রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন-
من أحب سنتي فقد أحبني ومن أحبني كان معي في الجنة
অর্থ: যে ব্যক্তি আমার সুন্নতকে ভালোবাসে সে আমাকে ভালোবাসে আর যে আমাকে ভালোবাসে সে আমার সাথে জান্নাতে অবস্থান করবে। (তিরমিজি)
বিদায় হজ্জের ঐতিহাসিক ভাষণে বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ সা. দ্বীপ্তকণ্ঠে লক্ষ লক্ষ সমবেত মানুষের উদ্দেশ্যে বলেন, “আমি তোমাদের জন্য দুইটি জিনিস রেখে গেলাম। যে ব্যক্তি তা আঁকড়ে ধরবে সে পথভ্রষ্ট হবে না। তা হলো আল্লাহর কিতাব এবং আল্লাহর রসূলের সুন্নত”। পথভ্রষ্টতা থেকে বেঁচে থাকতে চাইলে উভয়ের থেকে দূরত্ব সৃষ্টি করার কোনো সুযোগ নেই, বরং আঁকড়ে ধরার মাঝেই রয়েছে সফলতা।
যে জিনিসের গুরুত্ব এত বেশি তার ফজিলতও অত্যাধিক হওয়াটা স্বাভাবিক বিষয়। যার গুরুত্ব বর্ণনায় কুরআনে কারীম ও হাদীসে নববীতে এত পরিমাণে গুরুত্ব বর্ণনা হওয়াটা এর অত্যাধিক ফজিলতের বিষয়টি স্মরণে এনে দেয়।
হাদীসে এসেছে, মিসওয়াকসহ যে নামায পড়া হয়, তা বিনা মিসওয়াকের নামাযের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি ফজীলত রাখে। মসজিদে জামাতের সাথে ফরজ নামাজ আদায় করলে ৫০০ গুণ সওয়াব পাওয়া যায়। (তিরমিজি)
বর্তমানে মিসওয়াকের মত অনেক সুন্নত দিন দিন বিলীনের পথে রয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, সাহাবাগণ মেসওয়াকের সুন্নত পালন করার কারণে বিনা যুদ্ধে জয় লাভ করেন। কাফেররা এ ভয়ে ময়দান ছেড়ে পলায়ন করেছিল। কাফেররা এ দৃশ্য দেখে ভেবেছিল, মুসলমানরা এটি আবার কোনো রণকৌশল অবলম্বন করছে যে, তারা গাছের ডাল দ্বারা দাঁতকে ধার করছে।
বর্তমান ফিতনার যুগে রাসূলের সুন্নত আঁকড়ে ধরা দিন দিন কঠিন হতে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে। ফিতনার এই জামানায় রাসূলের সুন্নতকে আঁকড়ে ধরার সওয়াবও অত্যাধিক। এ মর্মে রাসূলে কারীম সা.-এর একাধিক হাদীস পাওয়া যায়। তন্মধ্যে একটি হলো, “আমার উম্মতের ফেতনা-ফাসাদের যামানায় যে আমার একটি সুন্নতকে জিন্দা করল সে ১০০ শহীদের সওয়াব লাভ করবে।” (মেশকাতুল মাসাবীহ; হাদীস নং-১৭৬)
নবীজী সা. আরো বলেন, যে আমার একটি সুন্নতকে জিন্দা করল সে আমাকে ভালবাসল। আর যে আমাকে ভালোবাসলো সে আমার সাথে জান্নাতে অবস্থান করবে। (তিরমিযী; হাদীস নং-২৬৭৮)
সুন্নত ও আধুনিক বিজ্ঞান:
রাসূলে কারীম সা.-এর অধিকাংশ অভ্যাস তথা সুন্নত আজ আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত। দিন রাত গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা যেসব বিষয় সম্পর্কে মানুষকে জানাচ্ছেন, সেসব বিষয় নবীকূলের সর্দার চৌদ্দশত বছর পূর্বেই স্বীয় উম্মতকে শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন। তবে কিছু সুন্নত বিজ্ঞানীগণ বিজ্ঞানসম্মত বলেন না। এর কারণ বলা যেতে পারে তাদের গবেষণা সে পর্যন্ত পৌঁছায়নি।
রোজা ও অটোফেজি:
অটোফেজি শরীরকে ভাঙে না বরং শরীর গড়ে। আর অটোফেজি এর পদ্ধতিকে চালু করতে প্রয়োজন কিছুটা দীর্ঘ তবে সবিরাম উপবাস। যা রোজা রাখার মাধ্যমে খুব সহজেই আপনি করতে পারেন। তবে এসব কিছুই সুস্থ ব্যক্তির সুস্থতার জন্য। মাসের কিছুদিন রোজা রাখা প্রিয় নবীর সুন্নত। এ বিষয়টিই যেন জাপানের বিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওহশোমি এতদিন পর মানুষের সামনে উন্মুক্ত করে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ২০১৬ সালে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। (বিস্তারিত: প্রথম আলো, ৮ অক্টোবর ২০১৬)
খাওয়ার সুন্নাত ও আধুনিক বিজ্ঞান:
হযরত মোহাম্মদ সা.-এর খাবারের ব্যাপারেও অপূর্ব ও লক্ষ্যণীয় সুন্নত আছে। খাবার সময় তিনি পেট ভরে খেতেন না বরং কিছু অংশ খালি রাখতেন। আধুনিক বিজ্ঞানও এটি স্বীকৃতি দিয়েছে যে বর্তমানে মানুষের শরীরে বিস্তর রোগের মুখ্য কারণ গলা পর্যন্ত খাবার খাওয়া। এর কারণে গ্যাস্ট্রিক, পেটের ব্যাধি ইত্যাদি যেন আমাদের দৈনন্দিন ব্যাপার হয়ে গিয়েছে।
পান করার সুন্নত ও আধুনিক বিজ্ঞান:
প্রাণপ্রিয় নবীজী সা.-এর নিয়ম ছিল তিনি খাবারের মাঝে পানি পান করতেন না বরং খাবারের আগে পান করতেন। বিজ্ঞান বলে, খাওয়ার সময় মুখে যে লালা বের হয় তাতে অনেক ধরনের এনজাইম থাকে। এগুলো খাদ্যের উপাদানগুলো ভেঙে পরিপাকে সাহায্য করে। পাকস্থলীতে খাদ্য পরিপাকের জন্য অনেক পাচক রস বের হয়। আবার লিভার (যকৃত) পরিপাকে সাহায্য করে। খাওয়ার সময় প্রচুর পানি খেলে এই তিনটি ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি হয়। তাই স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা খাওয়ার সময় পানি খেতে নিষেধ করেন। এ জন্যই বলা হয় ফল বা মূল খাবারের পর পানি খেতে নেই। কারণ, এতে পাচক রস ও এনজাইমগুলোর কার্যকারিতা কমে যায়, শরীর সবটুকু পুষ্টি নিতে পারে না।
সিরকা ও আধুনিক বিজ্ঞান:
প্রিয় নবীজি সা. সিরকা পান করতেন। বর্তমান আধুনিক বিজ্ঞান বলে, সিরকা মানুষের হজম শক্তি বৃদ্ধি করে। ভেবে দেখুন, একেকটি সুন্নতে কী পরিমাণ ফায়দা।
খাবার বেশি বেশি চিবানো ও আধুনিক বিজ্ঞান:
প্রিয় নবীজি সা. যখন খাবার খেতেন, উত্তমরূপে চিবিয়ে চিবিয়ে খেতেন। আমরা সাধারণত এক লোকমা খাবার চার পাঁচবার চিবিয়েই খেয়ে নেই। কিন্তু খাবার বেশি চিবানো হলে তা পাকস্থলীতে চাপ কম ফেলে। আর এটা তো সহজেই বোঝা যায় যে, ভালোভাবে চিবালে পাকস্থলীতে চাপ কম পড়বে। তাই খাবার খুব ভালোভাবে চিবানো উচিৎ।
স্থায়ী সৌন্দর্যের রহস্য:
নামাজে সেজদা করার কারণে মুখের সমস্ত শিরা-উপশিরায় রক্ত প্রবাহিত হয়। এজন্য যারা নামাজ পড়ে, তাদের চেহারার মধ্যে তরতাজা ভাব বিদ্যমান থাকে। আর যারা নামাজ পড়ে না, তাদের চেহারার বিষণ্নতা থাকে। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, যে ব্যক্তি নামাজ পড়ে তার চেহারায় নূর থাকে।
মেসওয়াকের সুন্নত:
দিনব্যাপী মুখ ব্যস্ত থাকার কারণে মুখের ভিতরের জীবাণুরা তাদের ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর সুযোগ পায় না। বরং রাত্রে যখন ঘুমের দেশে হারিয়ে যাওয়া হয় তখন মুখের অভ্যন্তরীণ জীবাণুরা তাদের উদ্দেশ্য হাসিল করে। তাই বিজ্ঞানীদের মতে নিয়মিত ব্রাশ অথবা মেসওয়াক করা আবশ্যক। চৌদ্দশত বছর পূর্বে আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) নিয়মিত মেসওয়াক করে সেই শিক্ষা আমাদের প্রদান করেছেন।
সত্যিকার অর্থেই বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ সা.-এর প্রতিটি অভ্যাস তথা সুন্নতেই জাতির জন্য বিরাট উপকার রয়েছে। গবেষণার ভিত্তিতে যা ধীরে ধীরে বিজ্ঞানপ্রিয় ব্যক্তিবর্গও স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এমনকি অমুসলিম বিজ্ঞানীরাও তাদের নব্য আবিষ্কৃত বিষয় এতদিন পূর্ব থেকেই চলমান দেখে যারপরনাই বিস্মিত হচ্ছে। উপরোক্ত সুন্নত ব্যতীত আরো অনেক সুন্নত রয়েছে, যার ব্যাখ্যা বিজ্ঞান প্রদান করেছে। আজকের এই ফিতনা-ফাসাদের যুগে সুন্নত যেন বিলুপ্তপ্রায়। মুসলিমরা ব্যস্ত অমুসলিমদের অনুকরণে। অথচ মুসলিমদের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্বের স্থানে থাকার কথা প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মদ সা.-এর। আফসোস! জাতি ছুটছে এক ধ্বংসের পথে, অপকারি এক রাস্তায়। সুন্নত পরিত্যাগের কারণে ইবাদতগুলো যেমন পরিপূর্ণতা লাভে অক্ষম, তেমনিভাবে আমলগুলোও আল্লাহর প্রিয় হওয়ার চাইতে বহুদূরে থেকে যাচ্ছে। প্রতিটা ক্ষেত্রে অমুসলিমদের কাছে মুসলিমদের পরাজয়ের এটাও মূল কারণ যে, মুসলিমগণ সুন্নতের অনুসরণ করছে না। অতএব, ঐক্য বজায় রেখে, অমুসলিমদের পরাজিত করে পূর্বের ন্যায় মুমিনের শির জগতজুড়ে উঁচু করতে চাইলে ইত্তেবায়ে সুন্নতের কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহ তায়ালা সকলকে সকল ফরয, ওয়াজিবের পাশাপাশি সুন্নতকেও গুরুত্ব প্রদানের তৌফিক দান করুন। আমিন।
রাজিউল হাসান সিফাত (ফযিলত ২য় বর্ষ)
১৪৪২/৪৩ হিজরি শিক্ষাবর্ষের ছাত্র
Leave a Reply